মনোয়ার হোসেন টগবগে যুবক – মহাসড়কে লুক্সারিয়াস পরিবহনের ড্রাইভার – যেটা আমি পরে জেনেছি তার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় । ০২ মে ২০২০ ভোর ৫-৩০মিঃ আমি ক্যামেরার ব্যাগ নিয়ে মাটিকাটা ঢাকা সেনানিবাস এলাকায় তার সাথে দেখা – রিক্সা নিয়ে দাড়িয়ে ; চোখে মুখে কিছুটা হতাশার ছাপ । আমাকে দেখেই বল্লো স্যার যাবেন ? বললাম আমি নির্দিষ্ট কোন যায়গায় যাবোনা – তবে তোমাকে নিয়ে সারাদিন ঢাকা শহর ঘুরবো আর ছবি তুলবো । তুমি ঘন্টায় কত নিবা ? বল্লো ঘন্টায় ২০০ টাকা করে দেবেন । আমি বললাম না ১০০ টাকা করে দিবো- পুরো ঢাকা শহর ঘুরব যত ঘন্টা সময় লাগে – কতক্ষণ চুপ থেকে বল্লো যাবো স্যার তবে দুটি শর্ত আছে – প্রথম পুলিশ যেকোন যায়গায় আটকায়ে দিলে সেখানেই নামিয়ে দিব এবং আমার ইঞ্জিন রিক্সার ব্যাটারীটাও ফুলচার্য নাই তাই যেকোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে ! কভিড ১৯ মহামারীর তান্ডবে তখন ভয়ংকর লকডাউন ও গৃহবন্দী দশায় মানুষ বিপর্যস্ত ! রাস্তা-ঘাট যানবাহন ও জনমানব শুন্য । আছে শুধু কর্মহীন – গূহ হীন কিছু ক্ষুদার্ত মানুষ আর কিছু রিক্সাওয়ালা পেটের দায়ে যারা পুলিশের বাধার মুখেও রিক্সা চালায় ।! যাই হউক ভাগ্যে যা আছে তাই হবে বলে রিক্সায় উঠে বললাম চলো । রিক্সা চলছে লক ডাউন সড়কে ধীরস্থির গতিতে – মাঝে মাঝে থামচ্ছি ছবি তুলছি – চলছে রিক্সা গাবতলী পেরিয়ে বেড়ীবাঁধের রাস্তা ধরে থামলো গিয়ে রায়ের বাজার বধ্যভুমির বুদ্ধিজীবি স্মৃতি সোধের গা ঘেঁসে । সেখানে একটা ছোট্র চায়ের দোকান পাওয়া গেলো – দুজনে মিলে চা বন রুটি খেলাম – খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম দোকনে সামনে আবৃত করা তেরপালটির মাঝামাঝি একটাা বেশ বড় আকারের ছিদ্র দেখে ( স্মৃতিতে ভেসে উঠলো আলোকচিত্র ইতিহাসের একটি সোনালী অধ্যায় – এমনি ভাবে তাঁবুর একটি ছোট ছিদ্রের যাদুর পরশেই সড়কের পাশে তাঁবুর ভিতরে বিশ্রাম নেয়া অবস্থায় আরবীয় জ্যোতির্বিদ ইবনে আল হাইতাম (Ibne Al Haitam – father of optics ) ঐ ছোট ছিদ্র দিয়ে আসা আলোর প্রক্ষেপনে তাঁবুর অপর পাশের পর্দায় প্রতিফলিত উট ও অশ্বারোহীদের ছায়া মুর্তির মুভমেন্ট দেখে আঁতকে উঠলেন এবং পেয়ে গেলেন ক্যামেরা তত্ত্ব – এবং আবিস্কার করলেন পৃথিববীর সর্ব আধি পিনহোল ক্যামেরা .১০ম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ) এখানে একটা করোনা পোট্রেট ছবি তোলার নেশায় পেয়ে গেলো – এখন প্রয়োজন একজন মডেল ! এদিক সেদিক তাকিয়ে ছোখ পড়লো আমার প্রিয় সংগী রিক্সাওয়ালার উপর – দেখলাম ওর মুখে আমাদের জাতীয় পতাকার প্রতীকি রঙে একটি করোনা মুখোশ – সুতরাং ওকেই মডেল বানিয়ে অনেক গুলো ছবি তুল্লাম । এর পর আবার ছুটছে রিক্সা বেড়ী বাঁধের পথ ধরে মাঝে মাঝে থামাচ্ছি ছবি তুলছি -যেখানে দরকার ওকে মডেল বানাচ্ছি – সুদুর কামরাংগীর চর পেছনে রেখে বাবু বাজার পেরিয়ে সদরঘাট টারমিনাল – সেখান থেকে ছবি তুলে সয়াখারী বাজার – তাঁতী বাজার হয়ে কমলা পুর রেল স্টেশন – সেখান থেকে নিউমারকেটের উদ্দেশ্যে শুরু হলো পথচলা – ইঞ্জিনিয়ার ইনি্স্টিটিউটেরঙ্কাছা কাছি আসতেই মুষলধারে তুমুল বৃষ্টি – প্রায় ভেজা অবস্থায় আশ্রয় নিলাম সড়কের পাশে যাত্রী ছাউনিতে – রিক্সাওয়ালাও রিক্সা রেখে সেখানে আশ্রয় নিল – দীর্ঘ সময় বৃষ্টি ; তাই অলস দাঁড়িয়ে না থেকে ক্যামেরাটা রেইন কোটের ভেতর ঢুকিয়ে আমার রিক্সাওয়ালা সহ বৃষ্টি সড়কে বিভিন্ন দৃশ্যাবলীর ছবি তুল্লাম । বূষ্টি একটু কমতেই আবার ছুছে রিক্সা নিউ মারকেটের পথে – শাহবাগ অভার ব্রীজের নিচে আসতেই ব্যাটারির চার্জ গেল ফুরিয়ে এখন কি হবে ! রিক্সাওয়ালা বল্লো স্যার আপনি তাহলে নেমে যান কারন ইঞ্জিন রিক্সা অনেক ভারী আপনাক সহ নিয়ে পাায়ে চালানো খুব কঠিন হবে ! এর আগেও আরও তিনবার আমার রিক্সা থেকে পুলিশের বাধায় আমার নেমে পড়ার উপক্রম হয়েছিল তবে আমার অনুরোধ – উদ্দেশ্য ও সাথে থাকা প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা (অবঃ) ঢাকা সেনানিবাস হিসেবে স্থায়ী পরিচয়পত্রের সম্মানে নির্বিগ্ন ভাবে চলে এসেছি । আমার মুখে অসহায়ত্তের ভাব ( কারন রাস্তা যাবাহন শুন্য ) দেখে সহৃদয় রিক্সাওয়ালা বললেন উঠেন স্যার যত কষ্টই হউক আপনাকে নিয়ে যাব আপনার মাটিকাটা সেনানিবাসের বাসায় । ইঞ্জিনের রিক্সা ভর করলো মানবিক পায়ে – প্যডেলের গায়ে পড়তে থাকল অমানবিক কষ্ট শ্রমের পা – আমার নিষেধ সত্তে্বেও রিক্সা শহীদ মিনার নিউমারকেট হয়ে ছুটতে থাকলো সুদুরের পথে আপন ঠিকানায় । দীর্ঘ ৩ ঘন্টা অমানবিক কষ্টের পথ পাড়ি দিয়ে দুপুর ২টায় রিক্সা আমার মাটিকাটা বাসার সামনে এসে থামলো ! নেমে বললাম ভাই তোমাকে অমানবিক কষ্ট দিলাম ! কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মনোয়ার বল্লো স্যার বহু বছর যাবৎ মহা সড়কে গাড়ি চালাচ্ছি – বহু সুখ দুঃখের স্মৃতি আমার মনে পড়ে আবার অনেক ভুলে গেছি – কিন্তু আপনার সাথে আজ যে সময় কাটিয়েছি আমার যত কষ্টই হউক এটা আমার জীবনে সুখের স্মৃতি হয়ে থাকবে চিরদিন । এরপর তার চুক্তি অনুযায়ী তার ৮ শত টাকা ভাড়া হলেও আমি ১০০০ টাকার একটি নোট দিয়ে বললাম এটা পুরোটাই তোমার – সে আমার দিকে তাকিয়ে দুফোটা অশ্রু ফেলে বল্লো স্যার (বললাম স্যার নয় ভাই বলো) আজ আর রিক্সা চালাবোনা – চাল ডাল নিয়ে সোজা বাসায় যাবো ! ছেল মেয়ে না খেয়ে আছে ! আমি গেলে রান্না হবে – বলেই রিক্সা নিয়ে চলে যেতে থাকলো – আমি পেছন থেকে অপলকে তাকিয়ে থাকলাম আর মনে মনে স্বগোতোক্তি করলাম মহামারির এ দুঃসময়ে ১০০০ টাকা রিক্সা ভাড়া দিলাম এটা কি করে সম্ভব ! হ্যাঁ সম্ভব আলোকচিত্রের সন্মোহিনী যাদুর টানে এটা অবশ্যই সম্ভব! কারন ঘরে গুরুত্ত্বপূর্ন বাজার না করে ফিল্ম কেনা ও দল বেঁধে ফটো আউটিং ত্ত তা প্রসেস প্রিন্ট করার উদগ্র অভ্যাস আমাদের জেনারেশনের কাছে ছিল খুবই সাধারন ব্যাপার ! সুতরাং থামতে হচ্ছে এখানে কারন এটুকু টাইপ করতেই আমার প্রায় ২ ঘন্টা সময় পার হয়েছে।
০২ মে ২০২০
……………………
https://bimboophoto.com/
© আবদুল মালেক বাবুল এফবিপিএস ,এফবিপিএস (সন্মান)
© Abdul Malek Babul FBPS , Hon FBPS
https://bimboophoto.com/ : 01715298747