*দিনগুলি মোদের সোনার খাঁচায় রইবে চিরদিন*
ভয়ংকর এক বনভুমি এবং ভয়ংকর দুই বনবাসি !

তখন দল বেঁধে ফটো আউটিংয়ে বের হওয়ার বিষয়টি ছিল সম্মোহনী আবেগের এক স্বর্গীয় বহিঃপ্রকাশ! শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে ছায়া শীতল শ্যামল বাংলার অপরুপ রুপে সজ্জিত উদার প্রকৃতি , বিস্তীর্ন মাঠ , মাটি –মানুষের রাজ্যে ক্যামেরা কাঁধে হারিয়ে যাওয়ার অবাধ আনন্দের মৃদমন্দ সমীরণ হৃদয় আকাশে যে কি দোলা জাগাত তা প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন । তখন ছবি তোলা এবং সুকুমার শিল্প বৃত্তির চর্চা করাই ছিল এক মাত্র সাধনা । বর্তমান প্রজন্মের বেশীর ভাগ আলোকচিত্রীদের মত ছবি বিক্রি বা ছবি তুলে পয়সা কড়ি আয় করা যায় সেসব ছিল আমাদের কল্পনার অতীত!
তবে বিপিএস নামক বটবৃক্ষের ছায়ায় একত্রিত হয়ে সাংগঠনিক ভাবে বাংলাদেশে আলোকচিত্র শিল্পের উন্নয়ন – সার্বজনীন চর্চা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহনের একটা দুর্বার আকর্ষন সবার ভেতরে ছিল অবশ্যই । আলোকচিত্রাচার্য এম এ বেগের নেতৃত্ত্বে তখনকার আমাদের অগ্রজ একদল নিবেদিত আলোকচিত্র ব্যক্তিত্বদের অনুপ্রেরণায় আমরাও তখনকার প্রজন্ম আলোকচিত্রের এ বিশাল জগৎে নিজেদের নিরলস উৎসর্গ করি । তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় ৮০ দশকের শুরু থেকে ৯০ দশকের শেষ অব্দি পর্যন্ত বিপিএস বট বৃক্ষটি তার শিকল প্রসারিত করে জাতীয় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলদেশের আলোকচিত্রের প্রগতিকে এক স্বর্ণ মন্দিরের চুড়ায় প্রতিষ্ঠিত করে । এবং এ সময়ের মধ্যে বাংলদেশের আলোকচিত্র শিল্পীরা ৬০০(শ্রেষ্ঠ ,স্বর্ন পদক এবং প্রথম সহ ছয় শতাধিক) আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করে আত্ম পরিচয়ের মধ্য দিয়ে বিপিএস তথা মাতৃভূমি বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে এক সুউচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে । যে একদল আলোর পাখি ও সংগঠকদের চেষ্টা , সাধনা ও কৃতিত্ত্বে বাংলাদেশের আলোকচিত্রের সুকুমার চর্চা, উন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা (বিপিআই গঠন ১৬ জুলাই ১৯৯০ সাল) সহ আন্তর্জাতিক পরিচিতির সুবর্ন ইতিহাসের সোনালী অধ্যায় রচিত হয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম গুলো পরবর্তিতে আরও প্রসারিত লেখায় যুক্ত করার ইচ্ছে আছে আমার স্মৃতিরপাতার সামর্থ থেকে ।
আজকে যে স্মৃতির গল্পটা আমার এই ছবিটাতে সংক্ষেপে বলতে চেয়েছি তাই বলি । ১৯৯৬ সালে ঝিনু ভাইর ( তিনি তখন বিপিএস এর মহাসচিব – আমি ভাইস প্রেসিডেন্ট) একটি দ্রুতগামী মটর সাইকেল ছিল যা তিনি পংখী রাজের মত উড়াল দিয়ে বেপরোয়া চালাতেন এবং দলীয় ফটো আউটিংয়ের বাইরে এ মটর সাইকেলটি ছিল মাদের দ্বৈত আউটিংয়ের খুব জনপ্রিয় একটি বাহন । অজস্র ছবি তোলার এক আবেগাপ্লুত মানুষ ছিলেন ঝিনু ভাই । ছবি তুলতে বের হলেই পেছনে বসিয়ে উৎসাহী যে কাউকে নিয়ে যেতেন সংগী করে । আমার জানামতে আমাদের সহকর্মী জামাল উদ্দিন এক্ষেত্রে বেশী সংগ পেয়েছে – সারা বাংলাদেশ বিশেষ করে পাহাড়ী এলাকা চষে বেড়িয়েছেন দুজনে – তার পর ছিল বাশার , মনির এবং আরও অনেকে। ।
যাই হোক এম্নি ভাবে একদিন আমিও ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে ঝিনু ভাইর পেছনে বসে পড়লাম আউটিং অভিযানে ! অভিযান কথাটার অবতারনা এই কারনে করলাম ঝিনু ভাই যে ভয়াবহ গতিতে মটর সাইকেল চালাতেন তাতে তার ভ্রমন সংগী হত্তয়া ছিল আল্লাহর নামে নিজেকে সঁপে দেওয়া !
ঐদিন আমরা মুন্সীগঞ্জ যাত্রা করলাম । পথে কেরানী গঞ্জে বিশাল বন অতিক্রম করছিলাম । পথি মধ্যে দুজনেই সেখানে কিছু মজার দৃশ্যে আকৃষ্ট হয়ে ছবি তুলতে নেমে পড়লাম । নেশার ঘোরে হারিয়ে গিয়ে অনেক্ষণ এদিক সেদিক ছবি তুল্লাম । এক সময় খেয়াল করলাম ঝিনু ভাই এবং মোটর বাইক কোনটাই সেখানে নাই ! নির্জন বন কোথাও কেউ নেই ভয়ে শরীর কাঁপতে শুরু করলো ! আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লাম ! ভাবলাম বসে থাকি ! দেখা যাক কি হয় ! প্রায় বিশ মিনিট পর দেখি বনভুমি কাঁপিয়ে ঝিনু ভাই এসে হাজির! হন্ত দন্ত হয়ে বললেন সরি ভাই আপনি যে আমার সাথে আছেন তা ঐ মুহুর্তে ভুলে গেছি ! আমিতো বাইক টান দিয়ে প্রায় ১০ কি মি চলে গেছি ! হঠাৎ দেখি আপনি পেছনে নাই ! আবার পাগলা টান দিয়ে ব্যাক করলাম ! আমারও বুক কাঁপতে ছিল! না জানি আপনার কোন বিপদ হলো কিনা ! আমি শুধু মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে তার দুঃখ ভারাক্রান্ত অবয়বে অপলক তাকিয়ে থাকলাম – আর মনে মনে বলতে থাকলাম আলোকচিত্র শিল্প সত্যি এক অসাধারন শক্তিশালী মাধ্যম মানুষের পরাবাস্তবতা ও বাস্তবতার জগতে সম্মোহিনী এক মোহন বংশীবাদক যাদুকর !
অতপর আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে সারাদিন ছবি তোলার আনন্দ উপভোগ করলাম । এরই এক ফাঁকে আমি যখন ওনার মটর বাইকের পাশে বসে প্রায় ক্ষুদার্ত উদরে শ্রান্তি বিনোদন করছিলাম তখন ঝিনু ভাই আমাকে চাঙ্গা করার জন্য এই নষটালজিক স্মৃতিটি চিরঞ্জীব করেছেন ।